হামাস বই pdf ডাউনলোড ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের ভেতর বাহির

হামাস বই pdf ডাউনলোড ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের ভেতর বাহির, আলী আহমাদ মাবরুর বই pdf download, hamas pdf palestine mukti andoloner vetor bahir
হামাস বই pdf ডাউনলোড ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের ভেতর বাহির, আলী আহমাদ মাবরুর বই pdf download, hamas pdf palestine mukti andoloner vetor bahir


হামাসের উত্থান এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

একটু পড়ুন: পৃষ্ঠা: ৪১
সেই সময়ের এই সার্কেলগুলোর আলোচনায় যে বিষয়টি বারবার উঠত- কীভাবে ইখওয়ানকে আরও গতিশীল করা যায়। তবে তারা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারেন- ইজরাইলিরা ফিলিস্তিনকে দখল করার পর ফিলিস্তিনিরা তৎকালীন সময়গুলোতে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছিল, তার আলোকে সঠিক কর্মকৌশল গ্রহণের ক্ষমতা স্থানীয় ইখওয়ান নেতাদের নেই। আরও একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে- এরা কি স্বাধীন কোনো সংগঠন, নাকি গাজা সংগঠনেরই একটি বর্ধিত শাখা? 

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি ছাত্ররা ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করাটাও জরুরি মনে করে। কেননা, তাদের মনে হচ্ছিল- গাজার ইখওয়ানের নেতারা এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন না। এই প্রশ্নগুলোর সমাধান পাওয়ার জন্য ছাত্ররা বারবার বসেছে, মতবিনিময় এবং পরামর্শসভার আয়োজন করেছে। একসময় দেখা যায়, গাজার সংগঠনের সাথে অনেক চিন্তাই তারা মেলাতে পারছে না। ফলে তারা মূল সংগঠন থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল।


ফাতহি আশ- শিকাকি নামক এক ছাত্র গাজার সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন এই ধারাটির নেতৃত্ব দেয়। এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার ধারণাটি তিনি পান তাওফিক তৈয়্যব নামক সিরিয়ার একজন ছাত্রের একটি লেখা থেকে। লেখাটির শিরোনাম ছিল- দুদফা বিপর্যয়ের পর ইসলামপন্থিদের করণীয়। লেখাটার সূচনা বক্তব্যে লেখক ১৯৬৭ সালের ৫ জুনের ঘটনাকে ইসলামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন। কেননা, এই দিনই ইজরাইল জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং একই সঙ্গে পূর্ব জেরুজালেমও দখল করে নেয়। 

১৯৬৭ সালের এই ঘটনাটি আরব জাতীয়তাবাদের ওপর একটি চপেটাঘাত। ফলে বিভিন্ন স্থানে ইসলামি বিপ্লবের সূচনা হয়। তাওফিক তার লেখায় জেরুজালেম হারানোর বিষয়টিকে আরব জাতিগুলোর পরাজয়ের করুণ পরিণতি হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন- জেরুজালেম হারানোর বিষয়টি কি ১০৯৯ সালে ক্রুসেডারদের কাছে জেরুজালেম হারানোর মতো, নাকি ১২৩৭ সালে কর্ডোভা হারানোর মতো ক্ষতি, নাকি ১২৮৫ সালে বর্বর মোঙ্গলদের কাছে বাগদাদের পরাজয়ের মতো?

এই মৌলিক প্রশ্নটি তুলে তাওফিক বলেন- 'ওপরোক্ত ঘটনাবলির কোনোটাই জেরুজালেম শহরটিকে হারানোর মতো ক্ষতিকারক নয়। কেননা, ১৯৬৭ সালে শুধু জেরুজালেমের পতন হয়নি; বরং সমগ্র মুসলিম ও পুরো ইসলামি সভ্যতার ওপরও বিরাট আঘাত এসেছে।' তাই এই ঘটনাটিকে তিনি অন্য যেকোনো ঘটনার তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব বিস্তারকারী অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করেন।
এই লেখাটা অনলাইনে পাওয়া যায় www.qudsway.com শীর্ষক ওয়েবসাইটে

তাওফিকের মতে- '১৯৬৭ সালের ঘটনা মুসলিম উম্মাহ এবং তাদের ঈমানকে এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে- হয় এগুলো থাকবে, নাহয় বিলুপ্ত হবে। মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব থাকবে, নয়তো অনন্ত-মহাকালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন ও সংস্কৃতি থাকবে কিংবা বিলীন হবে। ইসলাম কি একটি শাশ্বত বিশ্বাস হিসেবে টিকে থাকবে, আরব জাতি কি তাদের পূর্বসূরিদের মতো বুক ফুলিয়ে পৃথিবীর বুকে ভাস্বর থাকবে, নাকি ইহুদিদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে নিজেদের ঈমান-আকিদা হারিয়ে দেউলিয়া হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে মূলত ফিলিস্তিনকে ঘিরেই।' সবশেষে তিনি বলেন, 'ফিলিস্তিনই হলো উম্মাহর জাগরণ এবং মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পথে জীবন দেওয়ার সবচেয়ে বড়ো ইস্যু। তাই ইসলামি আন্দোলনগুলোকে ফিলিস্তিনকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কেননা, ফিলিস্তিনের পরিণতি আর ইসলাম, ইসলামি আন্দোলন ও মুসলমানদের পরিণতি একই সূত্রে গাঁথা।'


অন্যদিকে, সে সময়ে ইসলামকেন্দ্রিক যে রাজনৈতিক ভাবনাগুলো মধ্যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো— ইখওয়ানও এই চিন্তাই লালন করত। তারা দাবি করত, শক্তিশালী একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই কেবল ফিলিস্তিনকে ইজরাইলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করা সম্ভব। তবে সেই ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আগে ইসলামি সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে- যার ভিত্তি হবে ওহির আলোকস্মাত শরিয়ত এবং সুবিবেচনাবোধ। আর সেই সমাজের মুসলিমরা হবে পবিত্র, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং তাকওয়ার বলে বলীয়ান ।

তারা জেরুজালেম হারানোর ঘটনাকে ইসলামি মূল্যবোধ হারানোর একটি ইঙ্গিত হিসেবেই বিবেচনা করতেন। তারা মনে করতেন, মুসলিমরা সত্যিকারের ইসলামি আদর্শ ও চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই এই অধঃপতন। তাই উম্মাহর সেই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, বিকল্প কোনো পথ নেই। তবে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর এই সংস্কারটি লাগবে সমাজের সর্বস্তরের লোকদের জন্য। ব্যক্তির সংস্কারের পাশপাশি পরিবার এবং গোটা সম্প্রদায়ের সংস্কারেরও কোনো বিকল্প নেই।


ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ইখওয়ানের বক্তব্য এমনটা হলেও এটা তাদের প্রাথমিক বা মৌলিক অবস্থান নয়। ১৯৪৮ সালে যখন ইজরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়, ইখওয়ান তখন শত শত স্বোচ্ছাসেবীকে ইজরাইলের মোকাবিলার জন্য ফিলিস্তিনে পাঠায়। কিন্তু তাদের এই জিহাদি চেতনা তৎকালীন আরব শাসকরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

তারা নিজেদের নেতৃত্ব নিয়ে শঙ্কায় পড়ে। ফলে দেশে দেশে ইখওয়ানকে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আরব দেশগুলোর শাসকদের সামনেও প্রশ্নটি চলে আসে- তারা ফিলিস্তিনের বিষয়ে কী ভাবছেন?

১৯৫০-৬০ সাল, এই সময়টাতে ইসলামপন্থি ও জাতীয়তাবাদীরা ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করতেই ব্যস্ত থাকত। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই দুই ধারার ছাত্ররা পড়তে আসত। তারা এই ইস্যুগুলো নিয়ে অনেক তর্ক-বিবাদে জড়িয়ে পড়ত। বিতর্কের মূল বিষয় ছিল- আরবরা কীভাবে ইহুদি আগ্রাসনকে মোকাবিলা করবে? তবে উভয় দলই ইহুদি আগ্রাসনকে সবচেয়ে বড়ো হুমকি বিবেচনা করত। ইসলামপন্থিরা দাবি করত- ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা তখনই সম্ভব, যখন ইসলামকে জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করা হবে। তাই অনৈসলামিক কোনো শক্তি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবে- তা ভাবাই সমীচীন হবে না। তারা প্রশ্ন উত্থাপন করল, মিশরের নাসের বা সিরিয়ার বাথ পার্টির অধীনে জিহাদ হবে কি না। কেননা, এই শাসকরাও নানা সময়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইহুদিদের দোসর হিসেবেই ভূমিকা পালন করেছে।


এর আগে '৬০-এর দশকের শেষ দিকে ইখওয়ানের কিছু সদস্য ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তারা ছিল জর্ডান উপত্যকায় নিজস্ব ঘাঁটি গড়ার পক্ষে, কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক ও লজিস্টিক কারণে তাদের ফাতাহ বা পিএলও'র আওতায় কাজ করা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না।

মিশরে পড়তে আসা ফিলিস্তিনি ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন, বিতর্ক আরও বেড়ে যায় ১৯৭০-এর মাঝামাঝি। ফাতাহ তখন তাদের কাছে ইসলামি শাখার (ইসলামিক ফাতাহ) আওতায় কাজ করার প্রস্তাব দেয়। ফাতাহ আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা লেবাননের বৈরুত থেকে একজন সদস্যকে প্রতিনিধি হিসেবে মিশরে পাঠায়। তিনি ছাত্রদের ইখওয়ানের আদর্শ নিয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। ইখওয়ান সদস্যরা আগাগোড়াই জিহাদ ও শাহাদাতকে সবচেয়ে চরম আকাঙ্ক্ষিত বিষয় মনে করত। 

যখন তাদের প্রশ্ন করা হলো- জিহাদ ও শাহাদাত যদি এতটাই আকাঙ্ক্ষিত হয়, তাহলে কেন সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিচ্ছেন না? ইখওয়ানের ছাত্ররা এর উত্তরে বলত- তারা জাতীয়তাবাদী ব্যানারের আওতায় জিহাদ করতে চায় না। ইখওয়ান মনে করতেন, ফাতাহ ইসলামিক শাখাটি খুলেছে ইসলামকে জীবনবিধান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নয়; বরং দলীয় স্বার্থের জন্য।

ফিলিস্তিন ইখওয়ান এবং কুয়েতের যোগসূত্র

একই সময়ে কুয়েতে ফিলিস্তিনের ইখওয়ান শাখাটি ভিন্ন কিছু সংকটে পড়ে। ফাতাহর উত্থান এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় পিএলও একমাত্র কন্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থিরা ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ১৯৫০ সালের শেষে কুয়েত অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় দেয়। এসব ফিলিস্তিনিরা ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং উন্নত জীবনযাপনের লোভে কুয়েতে আসে। যদিও ফিলিস্তিনের নিকটতম প্রতিবেশী সৌদি আরব এবং তারাও বেশ বড়ো ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। তারপরও কুয়েতকে তারা বেশি পছন্দ করত। কেননা, তারা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারত।


১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর কুয়েতে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে শ্রমিক কিংবা নানা পেশায় চাকরি নিয়ে অসংখ্য ফিলিস্তিনি গাজা, পশ্চিম তীর এবং জর্ডান থেকে পরিবারসহ কুয়েতে আসে। এর আগে যেসব ফিলিস্তিনি পেশাজীবী কুয়েতে এসেছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইখওয়ানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আবার বেশ কিছু তরুণ, যারা বিভিন্ন মিশরীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে, তারাও সে সময় চাকরির সন্ধানে কুয়েতে আসে। সব মিলিয়ে বড়ো সংখ্যক ফিলিস্তিনিই কুয়েতে এসে থিতু হয়।

১৯৭০ সালের শেষ দিকে কুয়েত ইখওয়ানের ছাত্রদের জন্য একটি আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। এই ছাত্ররাই '৮০'র দশকের শেষে হামাসের প্রতিষ্ঠার পেছনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। '৭০-এর দশকটি ছিল ইসলামের উত্থানের সময়- যখন অসংখ্য যুবক-যুবতি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। নাসেরের পতনের পর কুয়েতেও ইখওয়ানের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ইখওয়ানও এই সুযোগে জনগণের কাছে আরব জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পায়। ফলে তরুণদের কাছে ধীরে ধীরে আরব জাতীয়তাবাদের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে ।

তা ছাড়া কুয়েতে ইখওয়ানের পালে আরও হাওয়া লাগে, যখন নাসেরের মৃত্যুর পর মিশরের কারাগার থেকে অনেক ইখওয়ান নেতা কুয়েতে আসে। সেইসঙ্গে মিশরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়া উচ্চশিক্ষিত ফিলিস্তিনি যুবকরাও কুয়েতে আসা শুরু করে। এ রকমই একজন স্কলার ছিলেন হাসান আইউব। তিনি তাঁর জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে অসংখ্য মানুষকে ইসলামের পথে নিয়ে আসেন। তিনি শুক্রবারে বিভিন্ন খুতবায় যে বক্তব্য দিতেন, তা শোনার জন্য বিপুলসংখ্যক লোকসমাগম হতো। তার বক্তব্য অডিও ক্যাসেট আকারে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত। এমন কোনো সমসাময়িক ইস্যু ছিল না, যে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যেত না। তিনি ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, বিচার কার্যক্রম এবং দর্শনসহ নানা বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন। এর কিছুদিন পর তিনি ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক বিষয় এবং শরিয়তের বিভিন্ন বিধিবিধানের ওপর বই লেখা শুরু করেন।


সেই সময়ে ইখওয়ান অনুভব করে- চারদিক থেকে যে ভিন্নমতের আদর্শগুলো তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে, তার মোকাবিলায় জনশক্তিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সে সময়ের জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যক্তি, পরিবার এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে পশ্চিমা ধ্যানধারণা, ভাবাদর্শ, তথাকথিত উদারপন্থা বা মার্কসবাদের করালগ্রাস থেকে রক্ষা করা। তারা অনুধাবন করে- মুসলমানরা তার ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজসংক্রান্ত যেসব সমস্যায় ডুবে আছে, তার থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় শরিয়ার দ্বারস্থ হওয়া। এমনকী ইহুদিদের কবল থেকে ফিলিস্তিনকে উদ্ধার করতে চাইলেও শরিয়ার দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প পথ নেই। ২৪

মূলত দুটি কারণে ফিলিস্তিনের ইখওয়ান জাতীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। প্রথমত, ভয় ছিল- এই ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হলে তাদের ইসলামি সত্তাটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কেননা, এর আগে ফাতাহও এই ধরনের সংকটে পড়েছে। ফাতাহ আন্দোলনের ইয়াসির আরাফাত ছাড়া শীর্ষ সব নেতাই একসময় ইখওয়ানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অথচ দেখা গেল, দল চালাতে গিয়ে তারা একটা পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছে। এর জন্য নিজেদের ইসলামি চিন্তাধারাকে বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করল না।


দ্বিতীয়ত, কোন ইস্যুটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা নয়, তা নির্ণয় করতে ইখওয়ান নিজেদের প্রয়োজনীয় আস্থা ও সক্ষমতার সংকটটা ভালোভাবেই অনুভব করছিল। কারণ, দমন-পীড়ন এবং জুলুম-নির্যাতনে তারা গুটিয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই জাতীয় কিংবা জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে নির্ধারণ করতে পারছিল না। তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল- প্যান ইসলামিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে একটি ইসলামিক সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত, সংরক্ষণ এবং প্রকাশ করা। কারণ, অধিকাংশ আরব দেশেই তত দিনে ইসলামি আন্দোলনটি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ইখওয়ান সদস্যরা মনে করত- ইসলামিক বিধান প্রতিষ্ঠা করা না গেলে কোনো লক্ষ্যই অর্জন সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে তারা পূর্ববর্তী ব্যর্থতাগুলো সামনে রেখে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক যেকোনো প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করত।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে ইখওয়ান ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য শত শত স্বেচ্ছাসেবীকে প্রেরণ করল, সেই ইখওয়ান '৭০-এর দশকে এসে ফিলিস্তিনে জিহাদে অংশ নিতে পারল না। ফিলিস্তিনে যা ঘটল, সেটাকে তারা ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে উম্মাহর ওপর নেমে আসা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করল।
খালিদ মিশালের মতামত। তথ্যসূত্র: হামাস এ হিস্টোরি ফ্রম উইথিন

ইসলামি সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করে দেওয়াটা তারা ইসলামের পথ থেকে সরে আসার মূল কারণ হিসেবে অভিহিত করে। ইখওয়ানের মতে- এই সংকটের কারণেই ভিন্নধর্মীরা ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম ভূখণ্ডকে দখল করার সাহস পেয়েছে। এ থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র সমাধান আবারও ইসলামের পথে ফিরে আসা এবং ইসলামি চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া। যখন উম্মাহ ইসলামের হারানো একাত্মতা ফিরিয়ে আনবে এবং তা অটুট রাখতে সচেষ্ট হবে, তখনই শত্রুদের মোকাবিলা করার যোগ্যতা অর্জন করবে।


এমতাবস্থায় ইখওয়ান তাদের কর্মকৌশল পুনরায় বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। কেননা, এরই মধ্যে ইসলামিক পুনরুত্থানের ব্যাপারে তাদের মনোপলি অবস্থান অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আরও অনেক ইসলামিক গ্রুপ দৃশ্যপটে হাজির হয় এবং তারাও ইসলামিক চেতনা লালন করে। সার্বিকভাবে গোটা সমাজেই ধর্মের আবহ ও প্রভাব বেড়ে যায় এবং ইসলামি মূল্যবোধগুলো সমাজে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই পালিত হওয়া শুরু করে। এই অবস্থায় ইখওয়ান বুঝতে পারে- তারা যদি ইজরাইলের হাত থেকে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার ডাক দিতে বিলম্ব করে, তাহলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা ভয়ংকরভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে এবং জনগণ তাদের ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।

ইসলামি পুনরুত্থানের এই বক্তব্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় ছাত্র ও তরুণসমাজ। এই সময়ে তরুণসমাজ থেকে ইসলামি আন্দোলনে অন্তর্ভুক্তির হারও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ছিল। ১৯৭০ সালে এসে অন্য সব ইসলামি দলের মতো ইখওয়ানও মাধ্যমিক স্কুলছাত্রদের ব্যাপারে মনোযোগ দেয়। এই ছাত্রদের ইসলামি ছাত্র আন্দোলনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালায়। এ ক্ষেত্রে ইখওয়ানের সবচেয়ে বড়ো সফলতা আসে মসজিদগুলোতে। 

কেননা, মসজিদ কমিটিগুলোর মাধ্যমে তারা তরুণ সম্প্রদায়কে নানা ধরনের সামাজিক, বিনোদনমূলক এবং শিক্ষাসংক্রান্ত সেবা দেওয়ার সুযোগ পায়। কুয়েতস্থ ফিলিস্তিন ইখওয়ান ১৯৭০ সালের মাঝামাঝিতে সংগঠনের কাঠামোর আওতায় ছাত্র সংগঠন চালু করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ছিল সময়োপোযোগী সিদ্ধান্ত। এর পরপরই কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইখওয়ানের প্রথম ব্যাচ প্রবেশ করে। এই ব্যাচেরই একজন ছিলেন হামাসের সদ্য বিদায়ি রাজনৈতিক ব্যুরোপ্রধান খালিদ মিশাল।


খালিদ মিশালের জন্ম ১৯৫৬ সালে রামাল্লার সিলওয়াদ নামক গ্রামে। সেখানে তিনি ১১ বছর পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। এরপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ শুরু হলে জর্ডান আশ্রয় নেন। কিছুদিন পরই তরুণ খালিদ মিশাল জর্ডান ছেড়ে কুয়েতে পাড়ি জমান।

কেননা, কুয়েতে তার বাবা ১৯৬৭ সালের আগে থেকেই বসবাস করতেন। ১৯৭০ সালে নিজের প্রাথমিক লেভেলের পড়াশোনা শেষ করে খালিদ 'আব্দুল্লাহ আস সালিম সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলটিতে সেই সময়ে অভিজাত শ্রেণির লোকেরাই পড়াশোনা করার সুযোগ পেত। তা ছাড়া '৭০-এর দশকে এই স্কুলটিই ছিল সব ধরনের রাজনৈতিক ও আদর্শিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। স্কুলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় ১৯৭১ সালে তিনি ইখওয়ানে যোগ দেন। তিনি শুরু থেকেই ছিলেন ইখওয়ানের নিবেদিত একজন কর্মী। স্কুলের পড়াশোনার পর্ব শেষ হওয়ার পর কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৮ সালে সেখান থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর বেশ কয়েক বছর কুয়েতে থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতাও করেন।


কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনি ছাত্রদের একটি সমিতি ছিল- জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টিনিয়ান স্টুডেন্টস (জিইউপিএস)। এই সমিতিটি ছিল পুরোপুরি ফাতাহ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণে। ইসলামপন্থি ছাত্ররা শুরুর দিকে এই সমিতিকে এড়িয়ে চলত, কিন্তু ১৯৭৭ সালে তারা এই সমিতিতে যোগ দেওয়া এবং এর নেতৃস্থানীয় পদগুলোতে যাওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জেরুজালেম সফর করে ফিলিস্তিন ও ইজরাইলের মধ্যে সংঘাত অবসানের আহ্বান জানান। এই সফর ফিলিস্তিনি ছাত্রদের আরও উত্তেজিত করে। খালিদ মিশাল এবং তার সহকর্মীরা মিলে জিইউপিএস নির্বাচনের জন্য একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। ‘আল হক' বা 'সত্য' শিরোনামের সেই তালিকায় তারা তাদের বক্তব্যগুলো প্রচার করেন। প্রচারণার মূল বক্তব্য ছিল দুটো। একটি হলো, লেবানন যুদ্ধ ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে এই যুদ্ধের প্রভাব। দ্বিতীয়টি হলো, জেরুজালেমে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট সাদাতের সফর, ইজরাইলের পার্লামেন্টে বক্তব্য এবং এর পরিণতি।

তবে সময়ের ব্যবধানে জিইউপিএস-এর অধীনে কাজ করাটা একসময় রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, ইসলামপন্থিরা এই সমিতিতে অবহেলিত হতে থাকে। একটা পর্যায়ে বুঝতে পারে, এখানে থেকে তাদের ভাবনাগুলো কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। খালিদ মিশালের গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার দুই বছর পর ১৯৮০ সালে তার জুনিয়র সহকর্মীরা জিইউপিএস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এবং কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের ঘরানার ফিলিস্তিন সংঘ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পিএলও নিজেদের বলয়ে ফিলিস্তিনি ছাত্রদের রাখার জন্য যে ধরনের সংস্থাগুলো করেছিল, তার বিকল্প হিসেবে ফিলিস্তিনি ইখওয়ান প্রথম একটি বিকল্প ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।


কুয়েত ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন অব প্যালেস্টিনিয়ান স্টুডেন্টস' ছিল সেই সংগঠনের নাম। একই সময়ে শুধু আরব অঞ্চল নয়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং বেশ কিছু ইউরোপিয়ান দেশেও ফিলিস্তিনি ছাত্রদের নিয়ে এই ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব ছাত্রদের বেশিরভাগ পিএলও'র ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। যারা মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তাদের হতাশ করে দিয়ে পিএলও নেতারাও সেই স্বপ্নকে নির্দ্বিধায় বিক্রি করেছেন। পিএলও সকল উদ্বাস্তুকে তাদের বাড়িঘর ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কিছুই দিতে পারেনি; পারার কথাও নয়....

FAQ
হামাস বই: ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের ভেতর-বাহির
লেখক : আলী আহমাদ মাবরুর
প্রকাশনী : গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
বিষয় : আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিবিধ বই

হামাস বই pdf download ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের ভেতর বাহির, ডাউনলোড করতে নিচে ডাউনলোড বাটন ক্লিক করুন। ডাইরেক্ট লিংক।

Post a Comment

স্প্যাম কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকুন! ধন্যবাদ, পিডিএফ বই ডাউনলোড সমস্যা হচ্ছে? এখানে দেখুন>যেভাবে PDF ডাউনলোড করবেন?

Previous Next

نموذج الاتصال