সিসাঢালা প্রাচীর pdf ডাউনলোড

সিসাঢালা প্রাচীর pdf download, আহমাদ ফালুদ্দিন বই pdf download, sisadhala prachir pdf download, মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বই pdf download
সিসাঢালা প্রাচীর pdf download, আহমাদ ফালুদ্দিন বই pdf download, sisadhala prachir pdf download


খোরাসানের প্রাচীর
নিঃসন্দেহে কৌশলগত দিক থেকে আফগানযুদ্ধ ছিল ভয়ংকরভাবে ব্যর্থ।
-মার্ক মিলি, চেয়ারম্যান, জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ, ইউএসএ।

একটু পড়ুন:
বিমানের ঢাকা কাবুলের মাটি স্পর্শ করল। মাথায় তখন ঘুরছিল— যেন আমি মানবপ্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজে নেমেছি, লোকেরা পালাচ্ছে আর আমরা ভেতরে ঢুকছি। বিমানবন্দরটি সামরিক এলাকায়, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিরাপত্তার খাতিরে বিমানবন্দরের ভেতরেই যেন আমাদের থেকে যাওয়া উচিত, এমনই পরিস্থিতি। ক্যাপ্টেন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বেরোনোর পদ্ধতি ও সতর্কতার ব্যাপারে বলতে শুরু করল। কিন্তু দোহা থেকে আমাদেরকে কাবুলে নিয়ে আসা বিমানটির বিকট আওয়াজে আমাদের কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। পেছনের দরজা খোলা হলো। বাইরে তাকাতেই দেখলাম, কাবুলের আলো শহরবেষ্টিত পাহাড়গুলোর শিখরে ঝলমল করছে।

বেরিয়ে এলাম আমরা। প্রথমবারের মতো পা রাখলাম কাবুলের মাটিতে। শীতল প্রাকৃতিক বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল গায়ে। কয়েক ঘণ্টা আগেই দোহায় যেমন ছিলাম, এখানকার আবহাওয়া তার মতো উত্তপ্ত নয়। ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রকৃতি এখানে চঞ্চল। হাজার হাজার মার্কিন ও অন্যান্য সেনা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। ওদিকে আফগান নারী, পুরুষ ও শিশুদের দীর্ঘ সর্পিল সারি। তারা এগিয়ে চলেছে— ঠেসাঠেসি করে, একে-অন্যের সঙ্গে লেপটে গিয়ে। প্রথমেই যা দেখে আমি ধাক্কা খাই তা হলো, কারও মুখেই কোভিড-মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। মাস্ক এখানে যেন বিলাসিতা, কেবলই শখের কিছু। যারা নিত্যদিন জঙ্গি বিমানের বিকট আওয়াজ আর মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দের মধ্যে দিনাতিপাত করে, তাদের কাছে করোনা নিয়ে উদ্‌বেগ বাহুল্য বা বিলাসিতাই বটে।


ছাউনি ফেলে গোটা বিমানবন্দরকে যেন সেনানিবাসে পরিণত করা হয়েছে। কাছেই দাঁড়ানো একজন সেনাকে দেখতে পেলাম। মোটা উর্দিপরা, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। হাতে ঝুলছে রাইফেল। শরীরের সামান্য অংশই দেখা যায়। আমরা ওদের সতর্কদৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিলাম। কঠিন নিরাপত্তা আর বাড়াবাড়ি রকমের সতর্কতা দেখে মনে হয়, যেন আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপই কারও জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এই বুঝি আমাদের দিকে তাক করা হলো ভয়ংকর কোনো অস্ত্রের নল। হঠাৎ চার বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ল আমার। অক্টোবর, ২০১৭। এখানেই, হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। শত শত সাধারণ যাত্রীর সঙ্গে ইমিগ্রেশন শেষ করেছিলাম। আজকের এসবের কোনোকিছুই সেদিন ছিল না।

বিমানবন্দরের উঁচু দেয়াল ঘেঁষে আমরা এগোচ্ছি বেরোনোর গেইটের দিকে। হঠাৎ এক মার্কিন সেনা ধমকের সুরে বলল – কোথায় যেতে চাচ্ছেন?' হয়তো আশ্চর্য হচ্ছিল সে। বাইরে থেকে হাজারো আফগান নরনারী যেখানে পড়িমরি করে ভেতরে ঢুকছে, সেখানে আমরা কিনা বেরোতে চাচ্ছি! জানালাম ' বেরোতে চাই, আমরা সাংবাদিক।" সেনাটি আমাদের একজনকে বলল – 'আগে ভাবতাম শুধু সেনারাই বোধহয় পাগল হয়, এখন তো দেখি সাংবাদিকরা আমাদের চেয়েও বড় পাগল!'


তার কথায় আমি একটু কষ্ট পেলাম। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ল খোরাসান নিয়ে লেখা আব্বাস ইবনু আহনাফের পক্তিগুলো। অথচ এদের দেখে মনে হচ্ছে, এখানে যারা আসবে তাদের আর নিস্তার নেই। সে জন্যই লোকেরা কাবুল ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ইবনু আহনাফের খোরাসান সফরের পঙক্তিগুলো বিড়বিড় বিড়বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে এগোতে থাকি, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেনাসদস্যদের পাশ কাটিয়ে: 

ওরা বলে, আমাদের গন্তব্য খোরাসান,
আরোহণ পাহাড়ে পাহাড়ে-
হ্যাঁ, আমরা খোরাসানে এসেছি। 
আল্লাহর কী ফায়সালা, দিজলাবাসী মিশে যাচ্ছে জায়হানাবাসীর সঙ্গে 
এখানে এই নির্জন প্রান্তরে।
কালের দুর্বিপাক ঘিরে আছে আমাদের, 
কোথাও কোনো পথ নেই আর।

১: ইতিহাসে আপার খোরাসান বলতে যা বোঝানো হয়, তা বর্তমানের আফগানিস্তান, তুর্কিমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান ও ইরানের পূর্বাঞ্চলদ্বয়ের সমষ্টি। ২: আল- আগানি, আবুল ফারাজ ইসফাহানি : ৮/৩৮৮।


মূল ফটকের সামনে খাটোমতো এক মার্কিন সেনা দাঁড়িয়ে। সুঠামদেহী। কিন্তু দেখেই বোঝা যায়, অস্ত্রের ভারে বিষম ক্লান্ত সে। হাতে থাকি একটি রেজিস্ট্রার। সেদিকে চোখ রেখেই কথা বলছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী করছে সে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে কোন সে ঐশীবাণী পাঠ করে আত্মিক প্রশান্তি খুঁজছে! কয়েক মিনিট পরে একজন বেসামরিক লোক ঢুকল। হাত বাড়িয়ে প্রবেশকারীদের গুনে গুনে রেজিস্ট্রারে ওঠাচ্ছে। যারা তাকে অতিক্রম করে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে পারছিল, দেখে মনে হচ্ছিল যেন একেকজন পুনর্জন্ম লাভ করছে। এমন এক শহর থেকে যেন মুক্তি পাচ্ছে তারা যেখানে এরপর আর কোনো শাসন-শৃঙ্খলা থাকবে না, চলবে শুধুই বুলেট। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে উঠছিল একেকজন, যারা কোনো রকমে সীমাহীন অপেক্ষার এক সারি থেকে পালিয়ে বেঁচেছে, যাদের গত কয়েকদিন কেটেছে মানবস্তূপের মধ্যে। কিন্তু এরা ওই সেনাদের কাছে একেকটি সংখ্যামাত্র, যাদেরকে তালিকাভুক্ত করছে তারা—এর বেশি কিছু নয়।

আমরা যখন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সাবধান করে দিয়ে বলল সে : বাইরের পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক!'

আরও দু-পা এগোতেই আরেক সেনা চিৎকার দিয়ে উঠল :

★তোমরা কি আসলেই বেরোতে চাচ্ছ?"

আমরা তার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা ফটকের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার দেখতে পেলাম আসল পরিস্থিতি। হাজার হাজার বনি আদম ফটকের বাইরে অনবরত ঠেলাঠেলি করে চলেছে ভেতরে ঢোকার জন্য। আর আমরা সেদিকেই বেরোতে এসেছি। এরা সবাই ভয় ও আশা নিয়ে মুক্তির পথের সন্ধানে নেমেছে। বেকার কিছু যুবকের সামনে এটিই সুযোগ, পলায়নের এমন সুযোগ বারবার ফিরে আসে না। এদের অনেকেই একসময় মুজাহিদদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। নেতারা তাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে। এমন ভূমিতে অসহায় করে রেখে গেছে, যার প্রতিটি ইঞ্চি এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। মানবপাহাড় ঠেলে কোনোমতে বেরোলাম। মানুষের গাদাগাদি আর টানা অবস্থানের কারণে চারপাশ নোংরা ও দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে।


আমাদের কেউ একজন বলল, এ গন্ধ আমাকে মিনা ও মুজদালিফার রাতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে! তার কথায় আমি কষ্ট পেলাম। সুযোগ হলে আমাদের মিনার অতীত তুলে ধরতাম। বস্তুত মিনার রাতগুলো ছিল সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণের। কবিরা ওই রাতগুলোর কী সুন্দর বর্ণনাই না দিয়েছেন! বিশেষত ইবনু আবি রাবিআর কবিতা তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। সেখানকার সুগন্ধির কথা বর্ণনা করে নামিরি সাকাফি বলছেন :

নামান উপত্যকা সুঘ্রাণ ছড়ায় বাতাসে, যখন জায়নাব সুবাসিত নারীদের সঙ্গে চলে।

মিনার মুহাসসাব অঞ্চলে তারা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান করে;

এলোমেলো কিছু নেই, ধুলোবালি নেই। পরিস্থিতির কারণে আমি চুপ রইলাম। কাবুলের আল জাজিরা অফিসের কর্মকর্তা হামিদুল্লাহ শাহের সঙ্গে আমাদের একজন যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, যেন আমাদের নিতে আসে। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলো সে। আমেরিকানরা ইচ্ছে করেই যোগাযোগব্যবস্থার এমন হাল করে রেখেছে। অনেক চেষ্টার পর ব্যাগগুলো ফটকের বাইরে ফেলতে পারলাম, আর আমরা ভেতরেই অপেক্ষা করতে থাকলাম।

দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্তি বোধ করছিলাম। দেয়ালের কাছে গেলাম হেলান দিতে। নিচের দিকে আমার পায়ের কাছে শুয়ে থাকা এক মার্কিন সেনা চেঁচিয়ে উঠল। চোখ ফিরিয়ে দেখি প্রত্যেক কোনায় কোনায় ক্লান্তশ্রান্ত সাহেবজাদারা এভাবেই ঘুমিয়ে আছে। তাদের এ পরিস্থিতি দেখে আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল— সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা তার সেনাদের এখানে ফেলে যাওয়ার পর কখনো কি এমন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিল? গত ২০ বছরেও কি একটি সুশৃঙ্খল প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা গেল না? তাহলে কি আমেরিকাকে হঠাৎ ফিরে যেতে হচ্ছে, যার প্রস্তুতি চলছিল অনেক আগে থেকেই? নাকি এটি আফগানদের দৃঢ়তা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের দম্ভ চূর্ণ করে দেওয়ার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা?


আমি ঘুমন্ত সেনাটির থেকে একটু দূরে সরছিলাম আর ভাবছিলাম, সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে এ মাটির আচরণ কেমন ছিল। আমার সামনে কাবুলের সুউচ্চ পর্বতমালা স্পষ্ট ভেসে উঠল, যেগুলো আফগান জাতির চির অপরাজেয়তাকেই নির্দেশ করে। এখানে কোনো সাম্রাজ্যবাদী এসে কি নিরাপদে ফিরতে পেরেছে? নাকি আফগানরা প্রতিবারই দখলদার বহিরাগতদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং প্রত্যাখ্যান করেছে ওদের তাবেদারদের? জামালুদ্দিন আফগানর (১৮৩৮ – ১৮৯৭) ভাষায় — 'আফগানরা যুদ্ধবাজ এক জাতি, বহিরাগত কারও সামনে তারা মাথা নত করে না। "

ইতিহাসের পাতাগুলো আমার স্মৃতির দর্পণে একে একে ভেসে উঠতে লাগল। ১৮৪২

খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বাহিনীকে এখান থেকে নির্মূল করা হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের

আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৯-এ সোভিয়েত ইউনিয়নকেও 
তাতিম্মাতুল বায়ান ফি তারিখিল আফগান, জামালুদ্দিন আফগানি : ১৫

বিতাড়িত করা হয়।

হঠাৎ আফগান এক যুবক ফটকের ভেতরে প্রবেশ করায় আমার চিন্তায় ছেদ ঘটে।

হাত দুটো উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দায়িত্বরত সেনাসদস্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চেক

করার পর ভেতরে যাওয়ার ইশারা করে। সামনেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তির দূত বিমানটি দাঁড়িয়ে

আছে। আনন্দে যুবকের চেহারা যেন আটখানা। বিমানবন্দরের আশেপাশে মানবস্তূপের

প্রতিটি হৃদয়ই এ মুহূর্তের অপেক্ষায়। সেনাসদস্য তাকে ভেতরে যেতে বলছে, কিন্তু

যুবক সরছে না। সে কর্তব্যরত সেনাসদস্যের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে। তাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। এবার সেনাসদস্য নিজের দুই হাত প্রসারিত করল—একটি বিমানবন্দরের ভেতরের দিকে আরেকটি বনি আদমের জটলার দিকে এবং চিৎকার করে বলতে লাগল, অপশন দুটি : স্বাধীনতা চাইলে ভেতরে প্রবেশ করো, আর আফগানিস্তান চাইলে ফিরে যাও। 


আমি তাদের এতটা কাছাকাছি হলাম যে, তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। আফগান যুবক অনুনয় করে বলছিল,

—আমার পরিবারকে সুযোগ দিন! তাদের আমার সঙ্গে আসতে দিন! সেনাসদস্য এবার আরও জোর আওয়াজে স্বাধীনতা শব্দটি ফারসিতে রূপান্তরিত করে আগের কথা পুনরাবৃত্তি করল,

—যদি 'আজাদি' চাও তাহলে ভেতরে যাও। অন্যথায় আফগানিস্তানে ফিরে যাও। তোমার পরিবারকে কোনো সুযোগ দিতে পারছি না! তাদের মধ্যে তখনো কথোপকথন চলছিল। দেয়ালের পাশ থেকে এক পিঙ্গলবর্ণের সেনা চেঁচিয়ে বলল,

-ক্রিস। তার পাছায় একটা লাখি দিয়ে যেখান থেকে এসেছে সেখানে পাঠিয়ে দাও! যুবকটি অনুনয় করে যাচ্ছিল আর সেনাসদস্যটি সেদিকে কর্ণপাত না করেই তাকে বনি আদমের দলে ঠেলে দিলো। আমার দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছিল। শেষ পর্যন্ত বাইরে রাখা তালেবানের একটি গাড়ি অতিক্রম করে সে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। তালেবান সদস্যরা ফটকের সামনে থেকে মানুষের ভিড় কমানোর চেষ্টা করছিল, যার ওপাশেই মার্কিন সেনারা অবস্থান করছে। আমার সামনে নতুন এক আফগানিস্তানের চিত্র ভেসে উঠল। অস্ত্রসজ্জিত তালেবান সদস্যরা ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মার্কিন সেনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লোকদের বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে সহযোগিতা করছে।

কেউ কি এমন চিত্র কল্পনা করতে পারত যে, অস্ত্রসজ্জিত তালেবান মুজাহিদের আঙুল ট্রিগারের ওপর এবং একইসঙ্গে মার্কিন সেনাও তার কাছে দাঁড়িয়ে, অথচ মুজাহিদের বন্দুক গর্জে উঠবে না? তারা পরস্পরে কথা বলছে। একসঙ্গে মিলে লোকদের বিন্যস্ত করছে। এটিই কি তাহলে নতুন আফগানিস্তান? পরক্ষণেই মনে হলো, অসম্ভব কিছু নয়। আলজেরিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে, সবখানেই ঔপনিবেশিকদের বিদায়লগ্নে বিজেতারা তাদের সঙ্গে করমর্দন করেছে। কোনো এক দলকে নির্বাসিত করার মাধ্যমেই দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।


তালেবানরা ছিল আফগান যুবক। তাদের পোশাকও ছিল আফগানদের মতোই। আফগান সাধারণ জনগণ আর তাদের মধ্যকার একমাত্র পার্থক্য ছিল মেশিনগান। পোশাক আর দাড়ি তো আফগানদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। তাদের আচরণ মার্কিন সেনাদের থেকে আলাদা ছিল। আমেরিকানরা চ্যাঁচামেচি করছিল এবং হাত দিয়ে লোকদেরকে সতর্ক করছিল। আর তালেবানরা বন্দুকের গোড়ালি দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছিল। এবং ভয় দেখাতে মাঝেমধ্যে সেগুলো লাঠির মতো উঁচিয়ে ধরছিল। কিন্তু তাদের চেহারা ছিল হাস্যোজ্জ্বল এবং তারা কথা বলছিল সাধারণ মানুষের মতোই। অন্যদিকে মার্কিনদের চেহারা ছিল মলিন। বন্দুকের আড়ালে তারা নিজেদের চেহারা লুকাচ্ছিল। এই ভূমি ও ভূপতিদের অজানা ভয়ে তারা ছিল আড়ষ্ট। দীর্ঘক্ষণ ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। এত সময় আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেনাসদস্যটিকে চিন্তিত মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত কিছু একটা করতে এগিয়ে এল। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসকে ইশারা করল,

-আমার মতে তোমরা ওই বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে যেতে পারো, তোমাদের ব্যাগগুলো বাসে রেখে ভেতরে বসে যাও। তালেবান জওয়ানরা তোমাদের বেরোতে সহযোগিতা করবে।

ব্যাপারটা আমাদের মনে ধরল। কয়েক মিনিট পর আমরা বাসের ভেতরে গিয়ে বসলাম। গোল বাঁধল, যখনই বাসটি বেরোতে চেষ্টা করে, লোকজন ঠেলে সেটিকে আরও পিছিয়ে দেয়। আমি জানালার পাশে বসেছিলাম ভিড়ের মানুষগুলোকে খুব ভালো করে দেখব বলে। জানালার পাশেই দেখলাম একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। কোলে দুধের শিশু। সঙ্গে একজন পুরুষও আছে। ছবি তোলার জন্য আমার ফোন বের করলাম। মহিলাটি ইশারায় ছবি তুলতে নিষেধ করল। ফোন বন্ধ করে আবার পকেটে রেখে দিলাম। ঐতিহাসিক কয়েকটি মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করা আর হলো না। ড্রাইভার বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। 


বাসের চারদিক থেকে শুধু ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছিল। নড়ার মতো এক হাত জায়গাও পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে তালেবান জওয়ানরা আমাদের জন্য রাস্তা ফাঁকা করে দিতে চেষ্টা করে। অনেক কষ্টে রাস্তা কিছুটা খালি হয় এবং ভিড় কেটে কেটে আমাদের বাস চলতে শুরু করে।

জনসমুদ্রে সাঁতার কেটে শেষ পর্যন্ত আমরা রক্ষা পেলাম। বেরোতে বেরোতে ফজর হয়ে গেছে। অথচ আমরা বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলাম সন্ধ্যারাতে, কাবুলের স্থানীয় সময় রাত ৮টায়। তারপর যখন বিমানবন্দর ছেড়ে কাবুল প্রবেশ করছি তখন রাতের আধার বিদায় নিচ্ছে, যেভাবে বিদায় নিচ্ছে আমেরিকার ২০ বছরের আগ্রাসন। তাকিয়ে দেখি চেকপোস্টে তালেবান জওয়ানরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে মৃদু হাসি আর কাঁধে মার্কিন অস্ত্র শোভা পাচ্ছে। পেছনে বিমানবন্দরের দেয়ালের ওপাশ থেকে মার্কিন সেনাদের হেলমেটের ছায়া দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আসা আলোর ছটা যেন তাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছিল।


আফগানিস্তানের এ রুক্ষ ভূমিতে ২০ বছর চক্কর খাওয়ার পর মার্কিন সেনারা নিজেদের আখের গুছিয়ে অন্তিম সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরা আজ থেকে ২০ বছর আগে তালেবানকে শেষ করতে এখানে পা রেখেছিল। আজ বিতাড়িত হওয়ার আগ মুহূর্তে সেই তালেবানের হাতেই আফগানিস্তানের চাবি তুলে দিয়ে যাচ্ছে। কাবুলে প্রবেশ করছিলাম আর আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – কীভাবে ঘটলো এ সবকিছু?

ফ্রী pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না! ধন্যবাদ

FAQ: 
সিসাঢালা প্রাচীর বইটির মূল্য কত? 
ওয়াফিলাইফ বইটির মূল্য: 228 ৳

সিসাঢালা প্রাচীর বইটির লেখক কে?
লেখক: আহমাদ ফালুদ্দিন, 
অনুবাদ: মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম

সিসাঢালা প্রাচীর বইটি কোন বিষয় লেখা?
বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য

সিসাঢালা প্রাচীর বইটিতে কত পৃষ্ঠা রয়েছে? 184 রয়েছে

Download Link: সিসাঢালা প্রাচীর pdf বই

সিসাঢালা প্রাচীর pdf download করতে নিচে ডাউনলোড বাটন ক্লিক করুন।

Post a Comment

স্প্যাম কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকুন! ধন্যবাদ, পিডিএফ বই ডাউনলোড সমস্যা হচ্ছে? এখানে দেখুন>যেভাবে PDF ডাউনলোড করবেন?

Previous Next

نموذج الاتصال